,

হারানো যৌবন ফিরে পেতে চায় নবীগঞ্জের শাখা বরাক নদী

১০১টি স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হলেও করোনার কারণে থমকে যায়

মতিউর রহমান মুন্না : নবীগঞ্জের শাখা বরাক তার হারানো যৌবন ফিরে পেতে আকুতি জানাচ্ছে কিন্তু কেউই যেন শুনছে না। আকুতি-মিনতি, ফরিয়াদ কোন কিছুই যেন কানে ডুকছেনা কানওয়ালা কর্তা বাবুদের। শাখা বরাকের মায়াবি বুকে প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে শহরের ময়লা-আর্বজনা। একদিকে নদীতে তৈরি হচ্ছে ভাগাড় অন্যদিকে এই ভাগাড়ে আগুন দেওয়ায় ধোঁয়ায় আশপাশের মানুষ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন বলে অভিযোগ করছেন শহরবাসী।
তবে আশার আলো জ্বলেছিল ২০২০ সালে কিন্ত করোনা মহামারি সেই আলো নিভিয়ে দিয়ে গেছে। আর কেউ আলো দেখাতে পারেনি। এবার নদী দূষণ ও দখলের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনা তৈরী করতে রিভার উইংস নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
গল্পের শুরুটা ২০২০ সালের ২ মার্চ। নবীগঞ্জের শাখা বরাক নদী সচল ও প্রবাহমান রাখতে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষনা দেন। তৎকালিন জেলা প্রশাসক কামরুল হাসানের নির্দেশে নবীগঞ্জ উপজেলার শাখা বরাক নদী থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। করা হয় অবৈধ স্থাপনার তালিকা প্রণয়ন। নবীগঞ্জের শাখা বরাক নদীর ১০১টি স্থাপনা উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত হয়। আশার আলো জ্বলে নবীগঞ্জবাসীর মনে। আনন্দের জোয়ার দেখা যায় প্রকৃতি প্রেমিদের মাঝে। জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান নবীগঞ্জবাসী। অনেকেই মনে করেছিলেন হয়তো হারানো যৌবন ফিরে পাবে শাখা বরাক। ওই সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড, নবীগঞ্জ ভূমি অফিস ও পৌরসভার সার্ভেয়াররা সরেজমিনে দখলদারদের নাম তালিকাভূক্ত করে বিভিন্ন বাসা-মার্কেটে লাল রঙ দ্বারা চিহ্নিত করেন। পরে প্রশাসন অভিযান করে বেশ কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করেন। কিন্তু করোনা সংক্রমন বাড়ায় অভিযান শুরুর কিছুদিন পরই বন্ধ হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত নদী সচল ও প্রবাহমান রাখতে আর কোন কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি। শাখা বরাক তার যৌবন ফিরে পেতে আকুতি জানালেও আর কেউ শুনেননি। বর্তমানে শাখা বরাক নদীতে ফেলা হচ্ছে শহরের সকল ময়লা-আবর্জনা। বর্তমানে ডাক বাংলোর সামনে, সবজি বাজারের পেছনে, নোয়াপাড়া পয়েন্টে, শিবপাশা ব্রীজের নিকটে ও হাসপাতাল সংলগ্ন শাখা বরাকে ফেলা হচ্ছে এসব ময়লা। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, বাড়ছে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে রোগব্যাধি। কিন্তু নাকওলা জনপ্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্ট কারো নাকেই যেন এই পচা গন্ধ লাগছে না। যদিও স্থানীয়দের অভিযোগ তারা দামী গাড়ি দিয়ে দাপিয়ে বেড়ান তাই গাড়ির ভেতর দিয়ে গন্ধ তাদের নাকে পৌঁছায় না।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এক সময়ের উত্তাল স্রোতের বরাক নদী কালেরগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীপথ ফিরে পেতে বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেও যেন সুফল মিলছেনা হতভাগা এলাকাবাসীর। রাঘব বোয়ালদের চরাঞ্চল দখলের মহোৎসব চলছে। সচেতন মহলের অভিযোগ রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে প্রশাসন। এর ফলে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথগুলো বর্ষা মৌসুমে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সামান্য বৃষ্টিতেই শহরতলির সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়। নবনির্মিত সড়কগুলো অকালেই ভেঙ্গে পড়ে। এ নিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগও রয়েছে। যদিও চলতি বছরে ড্রেন নির্মাণের মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নবীগঞ্জ শেরপুর সড়কের ১নং ব্রীজের নিচ দিয়ে যে খালটি শিবপাশা ঠাকুর পাড়ার ভেতর প্রবাহিত হয়ে নোয়াপাড়া-শাখা বরাক নদীতে মিলিত হয়েছে এর অনেকটাই এখন দখলদারদের কবলে বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় শত কোটি টাকার ডিসির খতিয়ানভুক্ত খাস ভূমি দখল নিয়ে প্রশাসনের ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী শাখা বরাক নদীটি কালের আবর্তে দখলদারদের কবলে পড়ে একটি নালায় পরিণত হয়েছে। এসব যেন দেখার কেউই নেই। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর ও সুস্থ্য পরিবেশ প্রয়োজন। শহরের সেই পরিবেশ এখন হুমকির মুখে।
এ ব্যাপারে আলাপকালে ৭০ বছর বয়সী রহিম উদ্দিন বলেন, ২০ থেকে ২৫ বছর আগেও যে নদীতে ৫০০ মনের ওজনের নৌকা ধান, ইট, বালু, বাঁশ নিয়ে যাতায়াত করত। সময়ের পরিক্রমায় এখন রাস্তার ও বসতবাড়ির বৃষ্টির পানি পর্যন্ত ঠিকভাবে নিষ্কাশন হতে পারছে না। বর্তমানে শাখা বরাক নবীগঞ্জ বাজারের ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পৌর এলাকার আনমনু গ্রামের এমরান মিয়া বলেন, ‘এক সময় নবীগঞ্জ বাজারের সঙ্গে দেশের অন্যান্য স্থানের পণ্য পরিবহনের একমাত্র পানিপথ ছিল শাখা বরাক। আমরা এক সময় এই নদীতে সাতার কেটেছি, ব্রীজ থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ছি। অনেক খেলাধুলা করছি। বড় বড় নৌকা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। এই নদীতে আমাদের ছোটবেলার অনেক স্মৃতি আছে। বর্ষার সময় শাখা বরাকের পানি থৈ থৈ করতো। ময়লা আবর্জনায় এখন মরা খালে পরিনত হয়েছে। নদীটি পূর্ণখনন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।’
নদী দূষণ ও দখলের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনা তৈরী করতে রিভার উইনস নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন একদল সচেতন নাগরিক, তাদেরই একজন কীর্তিনারায়ন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফয়জুর রব পনি। পনি বলেন, ‘আমাদের নবীগঞ্জ শহরের প্রাণ, শহরের অস্তিত্ব শাখা বরাক নদী বছরের পর বছর ধরে চলা দূষণ আর দখলে আজ বিলিন প্রায়। কয়েক বছর ধরে ব্যাপক হারে দূষিত হচ্ছে, এই দূষিত হওয়ার পেছনে যে প্রতিষ্ঠানকে সবাই দায়ী করছে, সেটা হচ্ছে আমাদের পৌর প্রশাসন। তারা পৌর শহরের ময়লা সংগ্রহ করে তা এই নদীর উপরে ময়লার ভাগাড় বানিয়েছে। বর্তমানে আমাদের সহজ সরল দাবী নদীতে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে, পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যে ময়লা ফেলে ভাগাড় করা হয়েছে সেটা পরিষ্কার করতে হবে। আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে পৌরসভার মেয়র মহোদয় এর প্রতি আকুল আবেদন জানাই, আপনারা দয়া করে এই নদীকে আর অত্যাচার করবেন না।’
এই সংগঠনের আরেকজন সাংস্কৃতিক কর্মী পলাশ বণিক কলেন, ‘শহরের সকল ময়লা আবর্জনা পৌর কতৃপক্ষ সংগ্রহ করে তা এই নদীতে ফেলে যায়। আবার সন্ধার সময় এসব ময়লার স্তুপে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এটার কারণে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয় তা খুবই ক্ষতিকর।’
পরিবেশ কর্মী দিনারপুর কলেজের অধ্যক্ষ তনুজ রায় বলেন, ‘নবীগঞ্জ পৌর শহর চারিদিকেই শাখা বরাক নদী ধারা বেষ্টিত। কিন্তু কালের আবহে একসময়ের খরস্রোতা শাখা বরাক আজ ময়লা আবর্জনার স্তুপে পরিনত হয়েছে। নদী তার সৌন্দর্য্য ও যৌবন হারিয়েছে। প্রকৃতগত ভাবে নদীর যে প্রবাহ তা দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা তরুণ সমাজ এই নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দিতে চাই। নবীগঞ্জবাসীর আহবান এই নদীকে রক্ষা করার জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। নদীর জন্য স্থানীয় সরকারের পর্যাপ্ত বাজেট রাখা উচিত, শহরের জলবদ্ধতা নিরসনে নদী সংরক্ষনের জন্য বাজেট থাকা অত্যান্ত জরুরী।’
গতকাল শাখা বরাকের পাড়ে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করতে দেখা যায় লেঃ কর্ণেল (অবঃ) মুক্তিযোদ্ধা চন্দ্র কান্ত দাসকে। এসময় এ প্রতিবেকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন- ‘একসময় এই শাখা বরাকে টল টল পানি থাকতো, বড় বড় নৌকা চলাচল করতো। কিন্তু বর্তমানে এটা ডাস্টবিন হয়ে গেছে। আষার মাসে এতো পানি হতো, অনেক কৈ মাছ আসতো, আমরা হারিকেন জ্বালিয়ে কৈ মাছ ধরতাম। সেই পুরনো দৃশ্যগুলো এখন রূপকথার গল্প মনে হয়। আমি আবারো নদীর নব্যতা দেখতে চাই।’
‘শহরের ময়লা-আবর্জনা পৌর কর্তৃপক্ষ শাখা বরাকে ফেলে দেয়’ স্থানীয়দের এমন অভিযোগের ব্যাপারে নবীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ছাবির আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘এ অভিযোগ শতভাগ সত্য নয়। তবে আমি প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর শাখা বরাককে রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। সেটা আমাদের ডাক বাংলোর সামনে থেকে কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পরই করোনা মহামারি শুরু হলে এই কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। তবে আশা করছি পৌরসভার উদ্যোগে আবারও এ অভিযান শুরু হবে তবে শুধু ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারই নয়, যারা সরকারী জায়গা দখল করে নদীকে বাধাগ্রস্থ করছেন তাদের কাছ থেকে আমরা নদী উদ্ধার করবো।’ পৌরসভার ময়লার বিষয়ে মেয়র বলেন ‘পৌরসভার ময়লা ফেলার জন্য যেহেতু কোন ড্রাম্পিং স্টেশন নেই, সেহেতু অনেক সময় আমাদের সিদ্ধান্তের বাহিরেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা পেলে দেয়। তবে এই বিষয়টি আমরা সর্তকভাবে দেখার চেষ্টা করছি। আর যাতে নদীতে ময়লা না ফেলা হয় তার বিকল্প ব্যবস্থাও আমরা নিচ্ছি।’
ডাম্পিং স্টেশন স্থাপন হলে নবীগঞ্জ শহর শতভাগ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শহরে রূপান্তরিত হবে বলে মনে করেন মেয়র ছাবির আহমদ চৌধুরী।


     এই বিভাগের আরো খবর